বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ১১:৪৬ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

শিক্ষকরা দায়মুক্ত নন

আবদুল্লাহ আল মোহন:
শিক্ষক তারাই, যারা শিক্ষা দেন। সমাজ সংসারে অনেক শ্রেণির মানুষ রয়েছেন, যারা শিক্ষা দেন। কিন্তু আজকের লেখা, মূলত তাদের নিয়ে, যারা বিদ্যা শিক্ষা দেন। এটা প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। বর্তমানে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নিয়ে অনেক সমালোচনা হচ্ছে। যেগুলোর অধিকাংশই নেতিবাচক। কিন্তু অতীতের সঙ্গে বর্তমানের পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিলে, বড় ধরনের ভুল হতে পারে। এক্ষেত্রে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে আমাদের বর্তমান সামাজ কাঠামোকে। দুর্নীতি, আত্মকেন্দ্রিকতা, অসহিষ্ণুতা এবং মাত্রাতিরিক্ত লোভ-লালসা সমাজকে অস্থির করে ফেলছে। এই অবস্থায় সেই সমাজেরই একটি শ্রেণি নিজেকে কতটুকু দায়মুক্ত রাখতে পারে? আরেকটু গভীরে গেলে দেখা যাবে, শিক্ষক শ্রেণি অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজেদের অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো একটি সুরুচিসম্পন্ন সর্বজনীন পেশার মানুষকে ভিন্নভাবে চিহ্নিত করতে পারে না। মনে রাখতে হবে, পাঠদান করলেই শিক্ষক হওয়া যায় না। শিক্ষক তারাই যারা স্বপ্নবান নবীন প্রাণকে আলোকিত করেন, আচরণের স্থায়ী পরিবর্তনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। যুক্তিবাদী ও মানবিক সুচিন্তায় উদ্বুদ্ধ করেন। দেশপ্রেম জাগ্রত করে সবাইকে ভালোবাসতে শেখান। বিশ্ববরেণ্য বাঙালি জাদুশিল্পী জুয়েল আইচের চরণ স্মরণ করতে চাই ‘ভালোবাসাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় ম্যাজিক।’ আর তাই যদি কোনো শিক্ষক কোনো শিক্ষার্থীর স্বপ্নমনে একবার সেই ভালোবাসার আলো জ্বালিয়ে দিতে পারেন, তাহলেই সমাজের সব অন্ধকার দূরীভূত হবে, আসবে প্রত্যাশিত মুক্তিও। ভালোবাসার সেই প্রবল ইচ্ছাশক্তির জাগরণ ঘটাতে, আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন শিক্ষকই।

২. পিতা-মাতার পাশাপাশি শিক্ষক আসলে শিক্ষার্থীকে ‘হয়ে ওঠা’র, সত্য কাজের জীবনদৃষ্টি দান করেন। শিক্ষার্থীর জীবনচর্যায় তার পরিবারও প্রতিষ্ঠান হিসেবে গভীর ভূমিকা রাখে। যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাখেন শিক্ষক। পিতা-মাতার আন্তরিকতা নিয়ে তেমন বিতর্ক না থাকলেও শিক্ষকের আন্তরিক ভূমিকা নিয়ে অনেকেরই সংশয় দেখা যায়। একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের প্রতি একাত্মতা কতটা অনুভব করেন, সেটাও সবিশেষ গুরুত্ব বহন করে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে। গ্রামের স্কুলে লেখাপড়ার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি আমাদের শিক্ষকরা সব শিক্ষার্থীকে সন্তানতুল্য বিবেচনা করতেন। সেটা তাদের জীবনাদর্শ ছাড়াও আরেকটি অন্যতম কারণ ছিল সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের নিজেদের সন্তানরাও শিক্ষা গ্রহণ করতেন। কিন্তু শিক্ষক হিসেবে আমার বিগত দেড় যুগের অভিজ্ঞতায় তেমনটা দৃশ্যমান হয়নি। ফলে শিক্ষক শিক্ষার্থীর প্রতি একাত্মতা কতটা আন্তরিক ও গভীরভাবে ধারণ করেন, যদি তার নিজের সন্তানটিও সতীর্থ হতো শ্রেণিকক্ষে, সেই প্রশ্নটি থেকেই যায়। এই একাত্মতা অনুভবের মাধ্যমে শিক্ষকতার দায়দায়িত্ব পালনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি প্রশিক্ষণের কিংবা অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন সম্ভব কি না সেটা আলোচনার দাবি রাখে।

৩. ‘শিক্ষা মানুষের মৌলিক চাহিদা এবং এটি এখন পণ্যে পরিণত, ক্রয়-বিক্রয়ের সামগ্রী।’ সমাজচিন্তকদের এই সমলোচনায় না গিয়ে ঘটনাচক্রে যিনি চলে এসেছেন শিক্ষকতার পেশায়, তিনি হয়তো অন্য কোনো পেশার জন্য যোগ্য ছিলেন, এই জরুরি বিষয়ে নজর দিতে পারি। নিজ প্রবণতার বাইরে গিয়ে জীবনের প্রয়োজনে শিক্ষকতাকে চাকরি হিসেবে নেওয়ায় প্রত্যাশিত মাত্রার মনোযোগ দিতে পারেন না শিক্ষার্থীর প্রতি। আন্তরিকতার ঘাটতির দেখা মেলে পরিপত্রে নির্দেশনা থাকার পরও গ্রন্থাগার দিবস পালন শেষে কিংবা ভাষা ও বইমেলার মাসেও বইয়ের চেয়ে বিছানার চাদর কিংবা থালাবাটির প্রতি অনেক শিক্ষকের একান্ত মোহাচ্ছন্নতা প্রীতির। এ রকম কথা ও কাজের বৈপরীত্য থাকায় শিক্ষকের দায়দায়িত্ব যেমন অনুকরণযোগ্য হয় না, সেই সঙ্গে তিনি প্রশ্নবিদ্ধও হন। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে দৃশ্যমান কার্যক্রম পরিচালনা, বিশেষত ছাত্রীদের জন্য ব্যবহার উপযোগী টয়লেট এবং কমনরুমের দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে জরুরি বিবেচনার অভাব। শিক্ষকসুলভ আচরণের এমনতর স্ববিরোধী কার্যক্রম তার মানসিক দৈন্যের প্রকাশ যে কাউকে কষ্ট দিতেই পারে।

৪. প্রত্যেক মানুষের জীবন দর্শন হয় পরিবার না হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। ‘মানুষ হয়ে ওঠা’র প্রক্রিয়ায় শিক্ষকের দায় ও শক্তি নিয়ে আমরা কতটা সক্রিয়? যদিও শিক্ষকের শক্তি কিন্তু মোটেই কম নয়। অন্যান্য যে কোনো পেশার চেয়ে প্রত্যাশার চাপ একটু বেশিই থাকে শিক্ষকের কাছে। যে চাপটাকে সহ্য করে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক মানসিকতায় আন্তরিকভাবে সজীব থাকতে পারেন যিনি, তিনিই আসলে মহান শিক্ষকের প্রতিনিধি রূপে নমস্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে সম্মানিত হন। যদিও রাষ্ট্রীয় কিংবা সরকারিভাবে শিক্ষকের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধাসহ প্রাপ্য মর্যাদা, সম্মান দিতে ক্ষমতাসীনদের আন্তরিক সচেষ্ট হওয়াটাও খুব জরুরি। শিক্ষকের নায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত না করে দায়দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের প্রয়োজনে ‘অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়ে’ নীতিরও প্রয়োগ জরুরি বিবেচনা করি। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সরকারি-বেসরকারি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রতি কি প্রয়োজনীয় মনোযোগ দিয়ে করণীয়গুলো বাস্তবায়ন করি? শিক্ষকরা সমাজ বিচ্ছিন্ন কোনো সত্তা নন। তাদের নায্য চাওয়া-পাওয়ার দাবি-দাওয়ার আহ্বান কতটা অভিভাবকদের সুনজরে আসে এ প্রশ্নও অনেককেই করতে শুনি।

৫. ‘শিক্ষকতা’ গভীরভাবে একটি জাগ্রত ও সৃজনী মানসিক সত্তার বিষয়। শিক্ষকের প্রবণতায় একাত্মতার সত্তা সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। শুধু আইন দিয়েই কাজ হয় না। মানসিকতার পরিবর্তনও জরুরি। শিক্ষক বিনোদন দেবেন না, জীবনাদর্শ সঞ্চারিত করবেন শিক্ষার্থীর মনে। তা না হলে মেধাবী শিক্ষার্থীও ক্ষমতার সর্বোচ্চ আসনে বসে জনকল্যাণের বদলে ব্যক্তিস্বার্থে দুর্নীতিতে নিমগ্ন হয়ে উঠতে পারেন। শিক্ষক আনন্দময় পরিবেশ সৃষ্টি করে শিক্ষাদান করবেন, সততার কাম্য আদর্শও নিজের জীবনাচরণ দিয়ে দৃশ্যমান করে তুলবেন। তাই নিয়োগকালে চাকরিপ্রার্থীর মানসিক প্রবণতা অভিক্ষেপ যাচাই করা জরুরি বিবেচনা করি। তা না হলে চাকরিজীবীই নিয়োগ করা হবে শিক্ষক নয়।

৬. শিক্ষাবিদরা যথার্থই বলেন, শিক্ষকতার কাজটা কখনোই একপক্ষীয় নয়। শিক্ষক কেবল যে দেনই তা নয়, তিনি পানও। যা তিনি পেয়ে থাকেন, তা সামান্য নয়। তিনি পান তারুণ্যের প্রবহমান সংস্পর্শ। এই সংস্পর্শ শিক্ষককে সজীব রাখে। শিক্ষার্থীরা চ্যালেঞ্জ নিয়েও আসে, সে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে গিয়ে শিক্ষক তার নিজের জ্ঞানের সঞ্চয়কে এবং বিতরণের কৌশলকে উন্নত করতে পারেন। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি অবশ্য চরিতার্থতা। শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করছে, গ্রহণ করে উদ্দীপ্ত ও সমৃদ্ধ হচ্ছে এই উপলব্ধি শিক্ষককে চরিতার্থতা দেয়। এমন চরিতার্থতা অন্য কোনো পেশা থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু প্রাপ্তিটা নির্ভর করে সমাজে শিক্ষার মূল্যের এবং শিক্ষককে সম্মান দানের আগ্রহের ওপর। যে সমাজ শিক্ষককে দীনহীন ও করুণার পাত্র করে রাখে, বুঝতে হবে তার নিজের মেরুদণ্ড শক্ত তো নয়ই, শক্ত যে হবে তারও আশা নেই।

৭. অনেক গুণের সমাহারে শিক্ষক। সন্তানের কাছে পিতামাতা আদর্শ মানুষ হতে পারেন, হতে পারেন গর্বের বস্তু, কিন্তু শিক্ষার্থীর কাছে নানাবিধ কারণে শিক্ষক একজন বীর। শিক্ষকের সাফল্য তার ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন রাখার ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। সে জন্য শিক্ষকের নিত্যসহচর হওয়া চাই, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্য জ্ঞান। তবে যদি কোনো সমস্যা থাকে, সেটা সব শিক্ষকের না। ব্যতিক্রম বাদে সব শিক্ষই কম-বেশি দায়দায়িত্ব নিয়ে বরাবরই সচেতন। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ যখন কাক্সিক্ষত নৈতিকতার মধ্যে থাকবে, তখন আর শিক্ষকের দায়দায়িত্ব নিয়ে কোনো ধরনের প্রশ্ন উঠবে না। শিক্ষক সবসময় শিক্ষা ও শিক্ষার্থীর প্রতি দায়িত্বশীল। সমাজেরও কিন্তু দায় রয়েছে একজন শিক্ষকের সংকটগুলোকে উপলব্ধি করে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসা।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ভাসানটেক সরকারি কলেজ

abdullahal@gmail.com

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION